The Ambassador News                                       দি অ্যাম্ব্যাসাডর নিউজ

সকল কণ্ঠের প্রতিনিধি

কী ছিল ১০ ট্রাক অস্ত্রের সেই ঘটনা? কে এই 'বাবর'?

সামীউল আলীম অর্ণবঃ 





(চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানার ঘাটে ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল রাতে অস্ত্র আটকের ঘটনা ছিল অনেকটা আকস্মিক। পুলিশের দুই কর্মকর্তার সঙ্গে ক্ষমতার দাপট দেখাতে গিয়ে বিপদে পড়ে অস্ত্র পাচারকারীরা এবং আটক হয় বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র।)




২০০৪ সালের ১ এপ্রিল রাত ১০ টা।

চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের তৎকালীন উপকমিশনার (বন্দর) আব্দুল্লাহ হেল বাকী ওয়্যারলেসের মাধ্যমে খবর পান সিইউএফএল জেটিঘাটে কিছু অবৈধ মালামাল ট্রলার থেকে ট্রাকে তোলা হচ্ছে। তাৎক্ষণিক তৎপর হন তিনি। রাত ১২টা ৫৫ মিনিতে কর্ণফুলী থানার ওসি আহাদুর রহমান ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে দুটি মাছ ধরা ট্রলার জেটিতে বাধা অবস্থায় দেখতে পান। ওই সময় একটি ক্রেনের সাহায্যে কিছু শ্রমিক দুটি ট্রলার থেকে মালামাল নামিয়ে পাঁচটি ট্রাকে বোঝাই করছিলেন।

ঘটনাস্থলে পুলিশের সংশ্লিষ্ট সদস্যদরা জানায়, বন্দর ফাঁড়ির দায়িত্ব শেষ হওয়ার আগেই সাদা পোশাকে সিইউএফএল ঘাটের পাশের খেয়াঘাট দিয়ে একটি নৌকায় নদী পার হন সার্জেন্ট আলাউদ্দীন। তখন ঘাটে কোনো ট্রলার ছিল না। তবে অস্ত্র আটক মামলার আসামি দীন মোহাম্মদ, আবুল কাশেম মধু, আরজু পাগলাসহ অন্যরা ঘাটে ছিলেন। সার্জেন্ট আলাউদ্দীনকে ঘাটে দেখে দীন মোহাম্মদ নদী পারাপারের জন্য একটি নৌকা ঠিক করে দেন।

এই নৌকায় ওপারে পৌঁছে ঘাটের পাশে সার্জেন্ট হেলালের সঙ্গে দেখা হওয়ার পরপরই বন্দর ফাঁড়ি থেকে হাবিলদার গোলাম রসুল মুঠোফোনে সার্জেন্ট আলাউদ্দীনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। গোলাম রসুল জানান, সিইউএফএল ঘাটে অস্ত্র নামছে বলে এক ব্যক্তি টেলিফোনে জানিয়েছে। পরপর দুবার ফোন পেয়ে হেলালকে সঙ্গে নিয়ে আলাউদ্দীন একই নৌকায় কর্ণফুলী নদী পাড়ি দিয়ে ছুটে যান সিইউএফএল ঘাটে। সার্জেন্ট হেলাল আগে এখানে দায়িত্ব পালনের কারণে ঘাটের অনেকেই তাঁর পরিচিত ছিলেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ছাড়াই হেলালকে সঙ্গে আনার এটাও অন্যতম কারণ ছিল বলে আলাউদ্দীন জানান।

দুই সার্জেন্ট এ পারে আসার পর দেখেন, দুটি ট্রলার ঘাটে নোঙর করা অবস্থায় আছে। বড়টি ঘাটের পাশে এবং অন্যটি সেটার গায়ে লাগানো।

এরপর দুই সার্জেন্ট ট্রলার দুটিতে কী হচ্ছে, তা দেখতে যান। তাঁরা দেখেন, কিছু শ্রমিক বড় ট্রলার থেকে কাঠের বাক্সগুলো ক্রেনের সাহায্যে ঘাটে রাখা ট্রাকে তুলে দিচ্ছেন।

সার্জেন্ট হেলাল কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে তাঁর পূর্বপরিচিত শ্রমিকসর্দার আরজু পাগলাকে দেখতে পেয়ে এসব মালামাল কার, তা জানতে চান। আরজু পাগলা জানান, মালের মালিক ঘাটে আছে। এরপর দুই সার্জেন্ট ঘাটে গিয়ে মালিককে খোঁজাখুঁজি শুরু করলে হাফিজ ও আবুল হোসেন (একজন শীর্ষস্থানীয় উলফা নেতা) জানান, তাঁরাই মালের মালিক। কোনো ভণিতা না করেই তাঁরা স্পষ্ট জানান, ‘ট্রলার দুটিতে অস্ত্রশস্ত্র আছে। প্রশাসনের সবাই বিষয়টি জানে।’

একপর্যায়ে পুলিশের দুই সার্জেন্টের সঙ্গে আবুল হোসেনকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে হাফিজ বলেন, ‘উনি উলফার নেতা, অস্ত্র তাঁদেরই।’ এসব অস্ত্রের কোনো বৈধ কাগজপত্র আছে কি না, তা পুলিশের দুই কর্মকর্তা জানতে চাইলে খেপে যান হাফিজ। উত্তেজিত হয়ে তিনি বলেন, ‘কিসের কাগজ, এই অস্ত্র আসার খবর সরকারের উচ্চপর্যায়ের সবার জানা আছে, এগুলো নামাতে বাধা দিলে আপনার ক্ষতি হবে।’

জানা যায়, পুলিশ ও অস্ত্র খালাসকারীদের মধ্যে এভাবে তর্ক শুরু হলে ঘাটের শ্রমিকেরা একে একে সরে পড়তে থাকেন। ঘাটশ্রমিকদের বলা হয়েছিল, পুলিশের বাধা তো দূরের কথা প্রয়োজনে কোস্টগার্ড এসে এগুলো খালাসে সাহায্য করবে। একপর্যায়ে অস্ত্র খালাসের কাজও সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।

ইতিমধ্যে খবর পেয়ে হাবিলদার গোলাম রসুলের নেতৃত্বে বন্দর ফাঁড়ির সব সদস্য, কর্ণফুলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আহাদুর রহমান, ঘাটের আনসারসহ আরও অনেকে ঘাটে এসে জড়ো হন। নিজেদের শক্তি বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি বুঝতে পেরে তখন দুই সার্জেন্ট অস্ত্র খালাসকারীদের সঙ্গে দরকষাকষির চেষ্টা চালান। কিন্তু হাফিজ টাকা দিয়ে সমঝোতার চেষ্টার পরিবর্তে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কথা বলে পুলিশের ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। এ সময় তিনি মুঠোফোনে ক্রমাগত বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করছিলেন।

একপর্যায়ে হাফিজ তাঁর মুঠোফোনটি সার্জেন্ট আলাউদ্দীনকে দিয়ে বলেন, ‘তোর বাপের সঙ্গে কথা বল, ডিজিএফআইয়ের বড় অফিসার লাইনে আছে।’ কিন্তু সার্জেন্ট আলাউদ্দীন ভয় পেয়ে ওই ফোনে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি পাল্টা বলেন, ‘আমি এবার তোমার বাপকে খবর দিচ্ছি। দেখি তোমাকে কে বাঁচায়?’



এরপর হেলালের সঙ্গে পরামর্শ করে আলাউদ্দীন ডিসি-পোর্টকে মুঠোফোনে অস্ত্র খালাসের বিষয়টি জানান। একই সঙ্গে তিনি কয়লার ডিপোর সার্জেন্ট হেলালসহ আশপাশের সব ফাঁড়ি থেকে পুলিশ পাঠানোর আবেদন জানান। ডিসি-পোর্ট আবদুল্লাহ হেল বাকি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে তাঁকে আশ্বস্ত করেন। এরপর ডিসি-পোর্ট আশপাশের সবাইকে ঘটনাস্থলে যাওয়ার বার্তা দিয়ে নিজেও আসছেন বলে জানান।



(দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় অভিযুক্ত আসামীরা)


ইতিমধ্যে হাফিজের সঙ্গে থাকা উলফা নেতা আবুল হোসেন নিজের মুঠোফোনে কারও সঙ্গে কথা বলে সার্জেন্ট আলাউদ্দীনকেও কথা বলার অনুরোধ করেন। আলাউদ্দীন ফোন ধরলে অপর প্রান্ত থেকে এক ব্যক্তি নিজের পরিচয় প্রকাশ না করে বলেন, ‘দেখুন, আমরা ১৯৭১ সালে আপনাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে অনেক সহায়তা করেছি। এসব অস্ত্রশস্ত্রও আপনাদের মতো আমাদের একটি স্বাধীন ভূখণ্ড সৃষ্টির কাজে লাগবে, আপনাদের কোনো ক্ষতি হবে না।’ এসব অস্ত্র নামানোর কাজে বাধা না দেওয়ার জন্যও তিনি অনুরোধ করেন।

হেলাল ঘটনাস্থলে গিয়ে মালামালের দাবিদারের সহযোগী পাঁচজনকে আটক করে বন্দর পুলিশ ফাঁড়িতে পাঠিয়ে দেন। ডিসি (পোর্ট) আব্দুল্লাহ হেল বাকী ঘটনাস্থলে গেলে আবুল হোসেনকে তার কাছে নিয়ে যান সার্জেন্ট হেলাল ও আলাউদ্দিন। এ সময় বাকী ও আবুল হোসেন দূরে গিয়ে কথা বলতে থাকেন। পরে আবুল হোসেনকে আর ঘটনাস্থলে দেখা যায়নি। মামলার তদন্ত চলাকালীন ওই আবুল হোসেনকে পরে টিআই প্যারেডে এনএসআইয়ের উপপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর লিয়াকত হোসেন হিসেবে শনাক্ত করেছিলেন হেলাল উদ্দিন। উপস্থিত পুলিশের একাধিক সদস্য জানান, হাফিজ ও তাঁর সঙ্গী বাদানুবাদের একপর্যায়ে পুলিশের দলকে একটি বড় অঙ্কের টাকা দেওয়ারও প্রস্তাব করেন। কিন্তু ততক্ষণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় পুলিশ টাকা নিতে রাজি হয়নি।





সরেজমিনে পরিদর্শনকালে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবর



সাক্ষ্যে সার্জেন্ট হেলাল জানান, ঘটনাস্থল থেকে তিনি যে পাঁচজনকে আটক করেছিলেন তাদের পরবর্তী সময়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর (লুৎফুজ্জামান বাবর) নির্দেশে ছেড়ে দেওয়া হয় বলে তিনি শুনেছেন। আবুল হোসেন নামধারী এনএসআই এর লিয়াকতকেও বাবরের নির্দেশে ছেড়ে দেওয়া হয় বলে আদালতে যুক্তি উপস্থাপনকালে বলেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী।


জানা যায়, এর ঘণ্টা খানেকের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে শুরু করেন। রাতেই বিষয়টি এমনভাবে জানাজানি হয়ে যায় যে, তখন আর কোনোভাবেই তা চেপে যাওয়ার কিংবা অস্ত্রবোঝাই ট্রাকগুলো ও ট্রলার দুটি ছেড়ে দেওয়া সম্ভব ছিল না। এ কারণে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের সিদ্ধান্ত নিতে প্রশাসন অনেকটা বাধ্য হয় বলে জানা যায়।



উদ্ধার করা আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে ছিল চীনের তৈরি একে-৪৭ রাইফেল, সেমি অটোমেটিক রাইফেল, রকেট লঞ্চার, রকেট শেল, পিস্তল, হ্যান্ড গ্রেনেড, বিপুল পরিমাণ গুলি ও বিস্ফোরক দ্রব্য। এই অস্ত্র যখন গণনা করা হয় তখন দেখা গেল ১ হাজার ৭৯০টি বিভিন্ন ধরণের অস্ত্র, সাড়ে ১১ লাখ গুলি, সাড়ে ৬ হাজার ম্যাগাজিন, ২৭ হাজার গ্রেনেড এবং ১৫০টি রকেট লঞ্চার।

উদ্ধার হওয়া অস্ত্রের কিছু অংশ 



নবীনতর পূর্বতন