The Ambassador News                                       দি অ্যাম্ব্যাসাডর নিউজ

সকল কণ্ঠের প্রতিনিধি

পানি কমলেও বাড়ছে মৃত্যু



বন্যার পানি নেমে যাচ্ছে, বেরিয়ে আসছে তছনছ হয়ে যাওয়া জনপদের মাঠঘাট। ভিটায় ফিরে নিজ চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছেন না তারা। ফেনীর পরশুরাম উপজেলার সীমান্তবর্তী দক্ষিণ বাউলপাথর গ্রামের এ পরিবারটিও হারিয়েছে তাদের সর্বস্ব। বৃহস্পতিবার তোলা -মামুনুর রশিদ



অমিতোষ পাল, ফেনী থেকে



বন্যা পরিস্থিতির উন্নতির বিপরীতে আছে বড় দুঃসংবাদও। একদিকে পানি কমছে, অন্যদিকে বাড়ছে লাশের সারি। ১১ জেলার বন্যায় গতকাল বৃহস্পতিবার মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫২। বুধবার এ সংখ্যা ছিল ৩১। সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি ফেনীতে। বুধবার পর্যন্ত এ জেলায় মারা গিয়েছিলেন দু’জন, আর গতকাল এক দিনেই উদ্ধার হয়েছে ১৫ লাশ। স্থানীয়রা ধারণা করছেন, মৃতের সংখ্যা আরও বেশি। সব লাশের খবর প্রশাসনের কাছে নেই। বিশেষ করে, এখনও মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক সচল না হওয়ায় দুর্গম এলাকার মৃত্যু সংবাদ প্রশাসনের কাছে আসছে না।
গতকাল সচিবালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী রেজা জানান, এখন পর্যন্ত ১১ জেলার ৬৮ উপজেলা বন্যায় প্লাবিত। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ফেনীতে ১৭, কুমিল্লায় ১৪, নোয়াখালীতে ৮, চট্টগ্রামে ৬, কক্সবাজারে ৩, খাগড়াছড়িতে ১, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১, লক্ষ্মীপুরে ১ ও মৌলভীবাজারে ১ জন রয়েছেন। এর মধ্যে ৩৯ জন পুরুষ, ৬ জন নারী ও সাতটি শিশু। এ ছাড়া মৌলভীবাজারে একজন নিখোঁজ আছেন। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এখনও ১০ লাখ ৭২ হাজার ৫৭৯টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে আছে। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৫৪ লাখ ৮০ হাজার ৪৬৩ জন। এখন পর্যন্ত আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে ৩ হাজার ৪০৩টি।

ভেসে আসছে লাশ
ফেনীতে প্রবল বন্যার মধ্যে কয়েক জায়গায় লাশ ভেসে আসতে দেখেছেন এলাকার মানুষ। এর মধ্যে তিনটি লাশ কলাগাছের ভেলায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। গত বুধবার বিকেলে ভেলায় ভাসমান অবস্থায় ফেনীর সোনাগাজীর মুহুরী নদী থেকে কাফনের কাপড় পরানো অচেনা অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। তাদের ধারণা, মৃত্যুর পর বন্যার কারণে দাফনের জায়গা না পেয়ে স্বজনরা হয়তো লাশ ভাসিয়ে দিয়েছেন। উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের বাদামতলী এলাকায় মুহুরী নদীর পাশে ঝোপের মধ্যে আটকে থাকা কলাগাছের ভেলা থেকে লাশ উদ্ধার করা হয়। তাৎক্ষণিক স্থানীয় লোকজন লাশের পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেননি। আনুমানিক ৬৫ বছর বয়সী ওই মৃত ব্যক্তির মুখে সাদা দাড়ি ও কাফনের কাপড়ের ভেতরে একটি বাদামি চাদর ছিল।



বাদামতলী এলাকার বাসিন্দা রবিউল ইসলাম বলেন, বন্যায় ফেনীর প্রায় সব উপজেলার বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। এ জন্য হয়তো স্বজনরা দাফনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ভেলা বানিয়ে কাফনের কাপড় পরিয়ে ভাসিয়ে দিয়েছেন। মানবিক দিক বিবেচনা করে লাশটি উদ্ধারের পর দাফন করা হয়েছে।
গত শনিবার রাতে ফেনী শহরের মিজান রোডে সোনালী ব্যাংকের সামনে হাঁটুপানিতে একটি লাশ ভেলায় ভাসতে দেখেন স্থানীয়রা। পরে কয়েকজন মানুষ সেই লাশটি জানাজা ও দাফনের জন্য নিয়ে যান। পরদিন রোববার ফেনী সদর উপজেলার লালপোল এলাকার উত্তর গোবিন্দপুর গ্রামে বন্যায় ভেসে আসে এক শিশুর লাশ। তা দেখে স্থানীয়রা সেখানে যান।
ওমান প্রবাসী মাসুদ খান ফেসবুকে লিখেছেন, তাঁর বাবা আলীম উল্লাহ (৭৩) মারা যাওয়ার পর লাশ কলার ভেলায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি সদর উপজেলার মোটবী ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাতসতী গ্রামের নাছির ভূঁইয়া বাড়ির বাসিন্দা। পরিবারের সদস্যরা জানান, আলীম উল্লাহ শুক্রবার ভোরে মারা যান। তখন পুরো গ্রাম পানিতে তলিয়ে ছিল। আলীম উল্লাকে কবর দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা করা যায়নি। শনিবার স্বজনরা মরদেহ ভেলায় ভাসিয়ে দেয়। সঙ্গে একটি চিরকুটে তাঁকে দাফনের অনুরোধ করা হয়। সেখানে ঠিকানাও দেওয়া হয়।


সহায়-সম্বল বলতে তাদের কিছু নেই
ভারত সীমান্তবর্তী ফেনীর পরশুরামের দক্ষিণ বাউরপাথর গ্রাম। ভারতের ত্রিপুরা থেকে আসা মুহুরী নদী এ গ্রামের পাশ দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। সেই নদীর পানিই তছনছ করে দিয়েছে ওই এলাকার মানুষের ছকে বাঁধা জীবন। এতটাই তাণ্ডব চালিয়ে গেছে যে, পানির তোড়ে অনেকের ভিটেমাটি প্রায় নিশ্চিহ্ন। এখন তারা থাকবে কোথায়, সে চিন্তায় কপালে পড়েছে ভাঁজ। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে খাবারের কষ্ট। আছে রোগব্যাধি, সাপ-পোকামাকড়ের ভয়। এ দুর্বিষহ পরিস্থিতির মধ্যেই এ গ্রামের ১১৭ পরিবারের দিন কাটছে।
গতকাল গ্রামটিতে গিয়ে দেখা গেছে, মানুষের হাহাকার। শরীরী ভাষায় ফুটে উঠছে তাদের ভীতির ছবি। এ গ্রামেরই বাসিন্দা দিনমজুর আব্দুর রহিম। তাঁর ছিল মাটির ঘর। বানের তোড়ে সেই ঘর শেষ।
গ্রামবাসী জানান, বন্যার সঙ্গে যে তারা পরিচিত নন, তা নয়। মুহুরী নদীর কারণে প্রায় প্রতিবছরই কম-বেশি বন্যা হয়। সেসব বন্যায় ক্ষেতের ফসলেরই একটু-আধটু ক্ষতি হয়। তবে এবার যা হলো, জীবনেও তা দেখেননি তারা। মুহুরী নদী এবার তাদের ভিটের মাটিও নিয়ে গেছে। এখন তারা রাস্তার ধারে বা অন্য কারও বাড়িতে থাকছেন। কোথায় যাবেন, কীভাবে পেট চলবে– এসব নিয়েই তাদের ভাবনা। গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগি পানিতে ভেসে গেছে। জমির ফসল শেষ হয়ে গেছে। সহায়-সম্বল বলতে তাদের এখন আর কিছুই নেই।
এ গ্রামেরই মুরুব্বি চান মিয়া বলেন, ‘১৯ আগস্ট শুরু হয় টানা বৃষ্টি। সেই সঙ্গে পানি বাড়তে থাকে। পরের দিন রাতে চারপাশ থেকে শুধু আহাজারি, হাহাকার আর চিৎকারের শব্দ শুনতে পাই। এর পর কিছু লোক আমার বাড়িতে আশ্রয় নেয়। গরু-ছাগলও নিয়ে আসে কেউ কেউ। তিন দিন আমার বাড়িতেই রান্না করে যা জুটেছে, সবাই খেয়েছে।’


বন্যা শুরুর পর থেকেই পরশুরামের সঙ্গে ফেনী শহরের যোগাযোগ বন্ধ। গত বুধবার শুরু হয়েছে যোগাযোগ। তবে ত্রাণের গাড়ি গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছতে পারছে না। যখনই কোনো ত্রাণের গাড়ি যায়, খন্দকিরা, পরশুরাম বাজারে গাড়িগুলো আটকে দেন বানভাসি মানুষ। দুর্গাচাঁদ মসজিদের কাছে কিছু লোক সব সময় বসে থাকে। যারা ত্রাণ নিয়ে আসে, তারা সেখানেই বিতরণ করে চলে যায়। দু-একটি গাড়ি বিলোনিয়া স্থলবন্দর এলাকায় ত্রাণ দিয়ে চলে যায়। ভাঙাচোরা আর সরু রাস্তার কারণে অজপাড়াগাঁয়ে কোনো গাড়িও ঢোকে না।

পরশুরামের বিলোনিয়ার উত্তর বাউরকুমার তালুকপাড়ার রাশেদা দেওয়ানের মাটির ঘরটিও বন্যায় ভেসে গেছে। তিনি জানান, ২০ বছর আগে তাঁর স্বামী মারা গেছেন। ছয় মেয়েকে বিভিন্ন জায়গায় বিয়ে দিয়েছেন। মাটির ঘর বানিয়ে একাই থাকতেন। সেদিন রাতে পাশের স্কুলে এক কাপড়ে চলে যান। তিন দিন পর ফিরে এসে আর কিছু পাননি। দু-একটি বালিশ ও দুটি লেপতোশক গাছের সঙ্গে আটকে ছিল। গতকাল সেগুলো রোদে শুকাতে দিয়েছেন রাশেদা দেওয়ান। তিনি বলেন, আজ স্বামী থাকলে আমার এমন অবস্থা হতো না। বিজিবির কয়েকজন লোক এসে কিছু চাল-ডাল-তেল-লবণ দিয়ে গেছে। আর কেউ আসেনি।
স্থানীয়রা জানান, উপজেলার কয়েকশ পরিবারের এখন ঘর বলতে কিছু নেই। তারা এখন ঠিকানাবিহীন। দক্ষিণ বাউরপাথরের বাসিন্দা আবদুল কুদ্দুস বলেন, মুহুরি নদীর পাড়ের বাঁধ না থাকা অংশ দিয়ে প্রথম পানি আসতে শুরু করে। দুবলারছাদ, খন্দকিরা, বাউরফুমা, বাউরপাথর– এ চার গ্রামের সঙ্গে কোনো বাঁধ নেই। এদিক দিয়েই প্রথম পানি ঢোকে। এর পর যেসব স্থানে বাঁধ আছে, সেগুলোও পানির তোড়ে ভেঙে যায়। এর পর আর কোনো কিছুতেই কাজ হয়নি। চারদিকে শুধু পানি আর পানি।
পরশুরামের সীমান্তবর্তী যে এলাকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেখানে চোখে পড়ে ভারতের সীমান্তবর্তী কাঁটাতারের বেড়া। আর বিলোনিয়া স্থলবন্দরের পশ্চিম পাশের কাঁটাতারের বেড়ার পাশ দিয়েই বয়ে গেছে মুহুরী নদী। সেই নদী এখন একেবারেই শান্ত। পানির স্তরও অনেক নিচে নেমে গেছে। দেখে বোঝার উপায় নেই, এ নদীই এলাকার মানুষের স্বাভাবিক জীবনকে ক’দিন আগে তছনছ করে দিয়ে গেছে।

পরশুরাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফরুজা হাবিব শাপলা বলেন, এই মুহূর্তে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখাটা সবচেয়ে বেশি জরুরি। ইতোমধ্যে উপজেলা নির্বাহী কার্যালয় থেকে ৩ হাজার মানুষকে ত্রাণ দেওয়া হয়েছে। পরশুরাম হাইস্কুল মাঠে একটি ক্যাম্প খোলা হয়েছে। সেখানে মানুষের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এর বাইরে সেনাবাহিনী ৮ হাজার মানুষকে ত্রাণ দিয়েছে। বেসরকারিভাবে যারা দিচ্ছে, সেটার সঠিক হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না।
এদিকে, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরের কোথাও কোথাও বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও অবনতি হয়েছে অনেক জায়গায়। তবে দুর্গম এলাকায় অনেকেই ত্রাণ পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রশাসন থেকে বলা হচ্ছে, পরিবহনের অভাবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ত্রাণ পৌঁছাতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে।



ূত্রঃ সমকাল
নবীনতর পূর্বতন