ফাইল ছবি |
হত্যার ঘটনাস্থল তিনটি, তিন হত্যাকাণ্ডের তারিখও ভিন্ন। কিন্তু তিনটি
মামলার এজাহারের বর্ণনা প্রায় এক। আসামিরাও অভিন্ন, তাঁদের নামের ক্রমবিন্যাসও এক।
এমন সাদৃশ্য দেখা গেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাজধানীর বাড্ডা থানা এলাকায়
সুমন সিকদার, হাফিজুল শিকদার ও সোহাগ মিয়া হত্যার ঘটনায় করা মামলাগুলোতে। বাড্ডা
থানায় করা এ তিন মামলার এজাহারে ভিন্নতা রয়েছে কেবল বাদী ও নিহতের নামে।
দুটি
মামলার বাদী অভিযোগ করেছেন, অন্য লোক এজাহার লিখে দিয়েছেন। তাঁরা শুধু স্বাক্ষর
করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, গত জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা অনেক মামলার
ক্ষেত্রে এমন হয়েছে। এজাহারে ভুল ও অসংগতিও রয়েছে। এজাহারে বাদীর ইচ্ছার প্রতিফলন
হয়নি।
ভুল
তথ্য ও গৎবাঁধা আসামির কারণে মামলার সুষ্ঠু তদন্ত বাধাগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না। তিনি বলেন, প্রতিটি হত্যার ঘটনা আলাদা, এর
সুষ্ঠু তদন্তের জন্য এফআইআর ও এজাহার সঠিক হওয়া প্রয়োজন। ভুল তথ্য ও অসংখ্য আসামির
কারণে তদন্ত কর্মকর্তার সময় নষ্ট হবে। তাই সঠিক তথ্য দিয়ে মামলা করা উচিত।
ঢাকা
মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মো. মাইনুল হাসান গতকাল শনিবার গণমাধ্যমকে বলেন,
যেসব মামলায় অসংগতি পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো তাঁরা তাঁদের প্রসিকিউশন বিভাগে
পাঠাচ্ছেন। প্রসিকিউশন বিভাগ এসব ঘটনা আদালতের নজরে আনবে। তারপর সেগুলোর বিষয়ে
আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এজাহারে
হুবহু মিল থাকা বাড্ডা থানার ওই তিনটি মামলার মধ্যে একটি হয়েছে গত ২০ আগস্ট। অপর
দুটি হয়েছে পরদিন ২১ আগস্ট।এর মধ্যে সুমন সিকদার হত্যা মামলাটি হয়েছে ২০ আগস্ট।
বাদী তাঁর মা মোসা. মাছুমা। এজাহারে তিনি অভিযোগ করেন, ১৯ জুলাই তাঁর ছেলে সুমন
সিকদার অফিসে যাওয়ার সময় বাড্ডার ফুজি টাওয়ারের সামনে গুলিতে নিহত হন। এজাহারে
তিনি আসামি হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
আসাদুজ্জামান খান, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানসহ ১৭৯ জনের নাম উল্লেখ
করেছেন। আসামিরা সবাই কেন্দ্রীয় ও বাড্ডা থানা আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের
নেতা।
রিকশাচালক
মো. হাফিজুল শিকদার হত্যার ঘটনায় ২১ আগস্ট মামলা করেন তাঁর বাবা মো. আবু বকর
শিকদার। তিনি এজাহারে উল্লেখ করেন, তাঁর বাসা পূর্ব বাড্ডার রূপনগর হলুদবাড়ি
এলাকায়। ২০ জুলাই বিকেলে তাঁর ছেলে হাফিজুল যাত্রী নিয়ে মেরুল বাড্ডার ডিআইটি
প্রজেক্ট দিয়ে প্রগতি সরণি যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। এই মামলায়ও আসামি
হিসেবে ১৭৯ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
এ
দুই এজাহার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সুমন হত্যা মামলায় ১৪ নম্বর আসামি হিসেবে নাম
রয়েছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়ার। কিন্তু হাফিজুল হত্যা
মামলায় তিনি আসামি নন। এ মামলায় ১৪ নম্বরে আসামি হিসেবে নাম রয়েছে বেসরকারি চ্যানেল
একাত্তর টেলিভিশনের সিইও মোজাম্মেল বাবুর। বাকি ১৭৮ জনের নাম ও ক্রমবিন্যাস
অভিন্ন।
অপর
মামলাটিও করা হয় ২১ আগস্ট। বাড্ডার লিংক রোডে ৫ আগস্ট সকালে সোহাগ মিয়া নামের এক
রাজমিস্ত্রি গুলিতে হত্যার অভিযোগে বাড্ডা থানায় এই মামলা করেন তাঁর বড় ভাই মো.
বিল্লাল মিয়া। তবে এই মামলায় আসামি হিসেবে নাম রয়েছে ১৭৮ জনের।
আসামির
তালিকায় ১৪ নম্বরে রয়েছে বিপ্লব বড়ুয়ার নাম। সুমন ও হাফিজুল হত্যা মামলায় আসামির
তালিকায় ১৭৯ নম্বরে থাকা হেলাল উদ্দিনের নাম এই মামলায় নেই। এ তিন মামলার
কোনোটিতেই হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত হিসেবে কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি। সব আসামিকেই
নির্দেশদাতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
পৃথক
তিন দিন ঘটা তিন হত্যার মামলার প্রায় হুবহু এজাহারের বিষয়ে জানতে চাইলে নিহত
হাফিজুলের বাবা আবু বকর শিকদার আজকের পত্রিকাকে গতকাল বলেন, তিনি থানায় গিয়ে কেবল
কাগজে স্বাক্ষর করেছেন। বাড্ডার একজন বিএনপি নেতা তাঁকে থানায় নিয়ে গিয়েছিলেন।
এজাহার, আসামির বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।
নিহত
সোহাগের ভাই বিল্লাল মিয়া বলেন, মামলা করার সময় পুলিশ তাঁকে সহযোগিতা করেছিল।
তাঁদের সহযোগিতায় আসামিদের নাম দেওয়া হয়েছে। তারাও কিছু নাম দিয়েছে, তিনিও কিছু
নাম দিয়েছেন। অন্য দুই মামলার সঙ্গে তাঁর মামলার আসামির তালিকার মিল থাকার বিষয়ে
জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে তাঁর জানা নেই। মামলার পর কোনো আসামি গ্রেপ্তার
হয়েছে কি না, তা-ও তিনি জানেন না। বড় বড় মানুষকে আসামি করায় তিনি আতঙ্কিত। বিভিন্ন
অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন আসে। এখন গ্রামের বাড়িতে আছেন।
তবে
বাদীদের এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বাড্ডা থানার ওসি মো. সাইফুল ইসলাম। তিনি
বলেন, বাদী যেভাবে এজাহার দেন, তাঁরা ঠিক সেভাবেই নেন। এখানে পুলিশের কিছু করার
নেই। এ ছাড়া আদালত থেকে যেসব এজাহার আসে, সেগুলোও পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই।
বাড্ডা
থানার তিনটি এজাহার প্রায় একই রকম হওয়ার বিষয়ে গতকাল দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় ডিএমপির
গুলশান বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ রিয়াজুল হকের। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এই
এজাহারগুলো নিয়ে পুলিশও বিরক্ত। প্রথমে থানায় এগুলো বাদীরা করেছেন। এখন আদালত
থেকেও একই রকম এজাহার আসছে। শত শত মামলা হওয়ায় যাচাই-বাছাই করার সুযোগ পাইনি।
এখন যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের আসামি
হিসেবে রাখা হবে। আর যারা জড়িত নয়, তাদের নাম মামলা থেকে প্রতিবেদন দিয়ে বাদ দেওয়া
হবে।’ এজাহারের ক্ষেত্রে পুলিশ সদস্যদের সহযোগিতার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এই
অভিযোগ সত্য নয়। বাদী যে এজাহার দিয়েছেন আমাদের সহকর্মীরা তা গ্রহণ করেছেন। গ্রহণ
করতে পুলিশ বাধ্য। এখানে পুলিশের কোনো হাত নেই।’
সূত্রঃআজকের পত্রিকা